ঢাকা ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শেরপুরে সাড়ে ৪শ’ বছরের জামাইবরণ কেল্লাপোষী মেলা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৫১:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ মে ২০১৫
  • ৩৩৮ বার

ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে। তিথি অনুযায়ী প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার উপজেলা সদরের অদূরে কেল্লাপোশী নামক স্থানে ৪৫৯ বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এ মেলার আয়োজন করা হয়। এবারও এই মেলার সার্বিক প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষায়, যাকে ‘জামাইবরণ’ মেলাও বলা হয়ে থাকে।

মেলাটিকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে চলে রকমারি আয়োজন। মেলার অন্তত সপ্তাহখানেক আগ থেকেই গ্রামের লোকজন প্রস্তুতি নিতে থাকেন। নতুন পুরনো বলে কথা নেই, মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনেন। বিশেষ করে নতুন জামাই-বউকে নিয়ে সবাই আনন্দে মেতে ওঠেন। শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে জামাইকে মোটা অঙ্কের সেলামিও দেয়া হয়। সেই সেলামি আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাইরা মেলা থেকে খাসি কিনে শ্বশুর বাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি মিষ্টান্ন, বিশাল বিশাল মাছ কিনে আনেন। শ্বশুর বাড়ির ছোটদের সার্কাস, নাগরদোলা, জাদু, পুতুল নাচ খেলা দেখিয়ে দিনব্যাপী আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের জন্য কাঠের ও ঝিনুকের খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। আর গ্রামের লোকজন সেই মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারা বছরের জন্য কিনে রাখেন।
এদিকে প্রতিটি মেলার পিছনেই কিছু না কিছু লোকগাঁথা কথা থাকে। কেল্লাপোশী মেলা সম্পর্কে তেমনি একটি লোকগাঁথার কথা জানা যায়। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ মেলা হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। এ সম্পর্কে জানা যায়, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরশজাত এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ঔরশজাত পুত্রের নাম ছিল গাজী মিয়া আর দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মণ রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। একপর্যায়ে তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার নিকট যান। মুকুট রাজা ফকিরবেশি যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দী করেন। এতে গাজী মিয়া দারুণ আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার নিকট থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী নামক একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর তিথি অনুযায়ী ওই দিনটি ছিল জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ-উত্সব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়।
অপরদিকে মেলা শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রংয়ে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার নানা সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা। জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে তা শেষ করে। এ বছরও মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মাদার খেলা চলে। আর ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে সামনে রেখে এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত কেল্লাপোশী নামক স্থানে ৩ দিনব্যাপী এ মেলায় যাত্রা, সার্কাস, নাগরদোলা, পুতুল নাচসহ নানা অনুষ্ঠান চলে। সেই সঙ্গে জুয়াড়িরা পাল্লা দিয়ে মেলা দেখতে আসা সহজ-সরল মানুষকে ঠকিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনা-কাটার ধুম। দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুটির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা। তিন দিন মেলা চলার নিয়ম থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত ছয়-সাত দিনে গড়ায়। এ মেলায় কোটি টাকার দ্রব্যাদি কেনাবেচা হয়। আর মেলাকে কেন্দ্র করে ইজারার নামে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। প্রতিবছর এই চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে থাকে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

শেরপুরে সাড়ে ৪শ’ বছরের জামাইবরণ কেল্লাপোষী মেলা

আপডেট টাইম : ০৬:৫১:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ মে ২০১৫

ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে। তিথি অনুযায়ী প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার উপজেলা সদরের অদূরে কেল্লাপোশী নামক স্থানে ৪৫৯ বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এ মেলার আয়োজন করা হয়। এবারও এই মেলার সার্বিক প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষায়, যাকে ‘জামাইবরণ’ মেলাও বলা হয়ে থাকে।

মেলাটিকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে চলে রকমারি আয়োজন। মেলার অন্তত সপ্তাহখানেক আগ থেকেই গ্রামের লোকজন প্রস্তুতি নিতে থাকেন। নতুন পুরনো বলে কথা নেই, মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনেন। বিশেষ করে নতুন জামাই-বউকে নিয়ে সবাই আনন্দে মেতে ওঠেন। শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে জামাইকে মোটা অঙ্কের সেলামিও দেয়া হয়। সেই সেলামি আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাইরা মেলা থেকে খাসি কিনে শ্বশুর বাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি মিষ্টান্ন, বিশাল বিশাল মাছ কিনে আনেন। শ্বশুর বাড়ির ছোটদের সার্কাস, নাগরদোলা, জাদু, পুতুল নাচ খেলা দেখিয়ে দিনব্যাপী আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের জন্য কাঠের ও ঝিনুকের খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। আর গ্রামের লোকজন সেই মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারা বছরের জন্য কিনে রাখেন।
এদিকে প্রতিটি মেলার পিছনেই কিছু না কিছু লোকগাঁথা কথা থাকে। কেল্লাপোশী মেলা সম্পর্কে তেমনি একটি লোকগাঁথার কথা জানা যায়। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ মেলা হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। এ সম্পর্কে জানা যায়, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরশজাত এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ঔরশজাত পুত্রের নাম ছিল গাজী মিয়া আর দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মণ রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। একপর্যায়ে তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার নিকট যান। মুকুট রাজা ফকিরবেশি যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দী করেন। এতে গাজী মিয়া দারুণ আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার নিকট থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী নামক একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর তিথি অনুযায়ী ওই দিনটি ছিল জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ-উত্সব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়।
অপরদিকে মেলা শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রংয়ে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার নানা সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা। জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে তা শেষ করে। এ বছরও মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মাদার খেলা চলে। আর ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে সামনে রেখে এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত কেল্লাপোশী নামক স্থানে ৩ দিনব্যাপী এ মেলায় যাত্রা, সার্কাস, নাগরদোলা, পুতুল নাচসহ নানা অনুষ্ঠান চলে। সেই সঙ্গে জুয়াড়িরা পাল্লা দিয়ে মেলা দেখতে আসা সহজ-সরল মানুষকে ঠকিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনা-কাটার ধুম। দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুটির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা। তিন দিন মেলা চলার নিয়ম থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত ছয়-সাত দিনে গড়ায়। এ মেলায় কোটি টাকার দ্রব্যাদি কেনাবেচা হয়। আর মেলাকে কেন্দ্র করে ইজারার নামে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। প্রতিবছর এই চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে থাকে।